Palestine

যেভাবে ফিলিস্তিনিদের রক্ত থেকে পৃথিবী লাভবান হয়

বড় বড় কর্পোরেশনগুলো ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহিংসতা থেকে যেভাবে উপকৃতএবং লাভবান হচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ জাতিসংঘের এই রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রাঞ্চেসকা আলবানিজের একটি রিপোর্টে দাবি করা হয় যে দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে দখলিকৃত এলাকা বাড়ানো, সামরিক অভিযান এবং নজরদারি সহজতর করার মাধ্যমে অ্যামাজন, গুগল, লকহিড মার্টিন এবং প্যালান্টিরের মতো বহুজাতিক কর্পোরেশন ইসরায়েলের আগ্রাসনকে সহায়তা করছে এবং তা থেকে লাভবান হচ্ছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদকের রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনের গণহত্যা বিষয়ক ইসরায়েলি নীতিগুলো সমর্থন করে এবং সেগুলো থেকে লাভবান হয় এমন কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক প্রকাশ করা হয়েছে।

১৯৬৭ সাল থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রাঞ্চেসকা আলবানিজ ১৬ জুন ২০২৫ তারিখে “দখলদারিত্বের অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি” শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। ৩৯ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টটি অ্যামাজন, ব্ল্যাকরক, গুগল, লকহিড মার্টিন এবং ভলভোর মতো বড় বড় বহুজাতিক কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি দখলদারিত্বএবং ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা থেকে লাভবান হওয়া নিয়ে অভিযোগ করেছে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির মতোখ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এই কোম্পানিগুলো ফিলিস্তিনিদের পরিকল্পিতভাবে বাস্তুচ্যুত করা এবং সেখানে ইসরায়েলিবসতি স্থাপনের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। বক্তব্য শেষে আলবানিজ সবার প্রতি আহ্বান জানান: গণহত্যা থেকে লাভবান হওয়াবন্ধ করুন এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন।

৯ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর আলবানিজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের সম্পত্তি ব্যবহার করতেবাধা দেয়। এমনকি আলবানিজ প্রকাশ্যে ইহুদিবাদবিরোধী প্রচার করেন, সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে্ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলএবং পশ্চিমের প্রতি স্পষ্ট অবমাননা প্রকাশ করেন বলে দাবি করে স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিজের এই সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে।এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ জানায় যে এই সিদ্ধান্ত একটি “বিপজ্জনক নজির” তৈরি করেছে। এসময় জাতিসংঘের মুখপাত্রস্টেফান দুজারিক জানান যে “জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক বা অন্য কোনো কর্মকর্তার উপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা গ্রহণযোগ্য নয়।” কেবল আলবানিজের সাথেই যে এমনটা হয়েছে তা কিন্তু নয়। ২০২৫ সালের জুন মাসে একই নির্বাহী আদেশের অধীনে আন্তর্জাতিকঅপরাধ আদালতের বিচারকদের উপরও ওয়াশিংটন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

জাতিসংঘের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে গণমাধ্যমে বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি হয়, যাফ্রাঞ্চেসকা আলবানিজ এবং তার দলের রিপোর্টের মূল বিষয় নিয়ে সব ধরণের আলোচনাকে দমিয়ে দেয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কোরুবিও এটিকে হেডলাইনে পরিণত করার জন্য রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন এবং অনেকাংশেসফলও হয়েছিলেন। এভাবে রিপোর্টে উত্থাপিত মূল প্রশ্নকে অবহেলা করে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিল, যার বিষয় ছিল:জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বৈধতা।

ক্লাউড ব্যবহার করে গণহত্যা

আলবানিজের রিপোর্টে ফিলিস্তিনের গণহত্যায় বড় বড় বহুজাতিক কর্পোরেশনের জড়িত থেকে লাভবান হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করাহয়েছে। এই কোম্পানিগুলো নির্মাণ থেকে শুরু করে শিক্ষা, অর্থ, সেবা এবং অস্ত্র উৎপাদন খাত জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে, লকহিডমার্টিনের মতো বৃহদাকার অস্ত্র কোম্পানিরও নাম রয়েছে। আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি (AFSC) এই কোম্পানিগুলোর পূর্নাঙ্গতালিকা তৈরি করেছে। শুধু অ্যামাজনের কথা চিন্তা করলেই আপনি এর ব্যাপ্তি বুঝতে পারবেন: ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীগাজার জনগণের সবধরনের ডেটা স্টোর করতে “অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস” সার্ভার ব্যবহার করে। ২০২১ সাল থেকে অ্যামাজনগুগলের সাথে মিলে “নিম্বাস” প্রকল্পের অংশ হিসাবে ইসরায়েলি সরকারের সাথে ১.২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। এই চুক্তিরঅধীনে তাদের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা সরবরাহ করতে হবে: যার মধ্যে আছে সেনাবাহিনী, শিন বেট, পুলিশ, কারাগার প্রশাসন, অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানী- যেমন ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ ও রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমসলিমিটেড; আর দখলকৃত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কোম্পানিগুলো।

আলবানিজের রিপোর্টে “প্রজেক্ট নিম্বাস”-এর কথা বলা হয়েছে এবং জানানো হয় যে এর প্রাথমিক তহবিলের উৎস হলো ইসরায়েলিপ্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়। তারপরে আরো জানানো হয় যে: মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট, অ্যামাজন- এদের সবাই ইসরায়েলকে নিজেদেরক্লাউড কম্পিউটিং কৌশল এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিগুলো অবাধে ব্যবহার করতে দেয়, যা ইসরায়েলের ডেটা প্রসেসিং, সিদ্ধান্তগ্রহণ, পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের ইন্টার্নাল মিলিটারি ক্লাউড ওভারলোড হলে মাইক্রোসফটের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম “আজুর” ও ইসরায়েলের “নিমবাস” মিলে প্রয়োজনীয় ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাঅবকাঠামো সরবরাহ করেছিল। ইসরায়েলে অবস্থিত এর সার্ভার ইসরায়েলের ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে এবং তাদেরজবাবদিহিতা থেকে বাঁচিয়ে দেয়, সেই সাথে তাদের সাথে করা নমনীয় চুক্তির কারণে ইসরায়েলের উপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা বা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে একজন ইসরায়েলি কর্নেল এই কোম্পানিগুলোর উদাহারন দেখিয়েক্লাউড প্রযুক্তিকে একটি মহার্ঘ অস্ত্র বলে দাবি করেছিলেন।

এটি স্পষ্ট যে টেক কোম্পানিগুলোর ভূমিকা কেবল ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং গণহত্যায় সহায়তা করতে তথ্য সরবরাহের মধ্যেইসীমাবদ্ধ নয়, এটি ইসরায়েলকে “একটি সুরক্ষা ঢাল” প্রদান করে। কারণ এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে তাদের যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ করার মতো জরুরি তথ্য গোপন করে। আলবানিজের রিপোর্টে সশস্ত্র বাহিনীর ডেটা প্রসেসিং-এর দায়িত্বে নিয়োজিত ইসরায়েলিসেনাবাহিনীর কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস সেন্টারের কমান্ডার কর্নেল র‍্যাচেলি ডেমবিনস্কির উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। তেলআবিবের নিকটে রিশন লে যিওনে অনুষ্ঠিত “ইসরায়েলি আর্মি ইনফরমেশন টেকনোলজি কনফারেন্স” -এ ডেমবিনস্কি বলেছিলেন যে তাদের সেনাবাহিনী বিশ্বের টেক জায়ান্টদের সরবরাহ করা ক্লাউড স্টোরেজ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেবার উপর নির্ভর করে: যার মধ্যে আছে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস, গুগল ক্লাউড এবং মাইক্রোসফট অ্যাজুর। তিনি আরও বলেন যে সামরিক ইউনিট “মামরাম” তারইন্টারনাল সার্ভারে এমন একটি “অপারেটিং ক্লাউড” ব্যবহার করে যাকে তিনি “অস্ত্রের প্ল্যাটফর্ম” হিসাবে বিবেচনা করেন। এইকোম্পানিগুলো আজ পর্যন্ত গণহত্যা থেকে কতটা লাভ করেছে সে সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্য নেই।

২০২৪ সালে অ্যামাজন এবং গুগলের কিছু কর্মচারী নিউ ইয়র্কে “নো টেক ফর অ্যাপারথাইড (NoTA) ক্যাম্পেইন” শুরু করে এবংগুগল ইসরায়েলের প্রতিনিধি বারাক রেগেভের সামনে বক্তৃতার দেয়ার সময় গুগল ক্লাউডের একজন নারী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারসবার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন: “আমি গণহত্যার পক্ষে কথা বলে, বর্ণবাদকে সমর্থন করে বা কারো ওপরে নজরদারি করে এমনপ্রযুক্তি তৈরি করবো না।” কোম্পানিটি এই কারণে ক্যাম্পেইনের সাথে যুক্ত কয়েক ডজন ইঞ্জিনিয়ারকে বরখাস্ত করেছিল। তবুও এইক্যাম্পেইন দমন করা যায়নি, বরং এতে তাদের প্রতিবাদ আরো জোরালো হয় এবং নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়।

অন্ধ

২০০৩ সালে পিটার থিয়েল তার অংশীদারদের সাথে “প্যালান্টির” নামের টেক কোম্পানি  প্রতিষ্ঠা করেন। “প্যালান্টির” নামটি এসেছে “ লর্ড অফ দ্য রিংস” উপন্যাস থেকে। এটি এমন একটি ক্রিস্টাল বল, যা ব্যবহার করে বহুদূরে ঘটা জিনিস দেখা যায়।থিয়েল তার রক্ষণশীল উদারনৈতিক প্রবণতা এবং “পশ্চিমা সভ্যতা”-র শ্রেষ্ঠত্বের উপর গভীর আস্থার জন্য বিখ্যাত। তিনি নিরাপত্তাএবং সামরিক চুক্তির ব্যবসায় নামার আগে “পেপ্যাল” এবং “ফেসবুক” এর মাধ্যমে ধনবান হয়েছিলেন। তিনি আমেরিকান সেন্ট্রালইন্টেলিজেন্স এজেন্সি “ইন-কিউ-টেল”-এর ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড “প্যালান্টির”-এর প্রথম বিনিয়োগকারী।” কোম্পানিটি  ২০১৫সাল থেকে ইসরায়েলে ব্যবসা করছে। এটি ডেটা বিশ্লেষণ, ইন্টিগ্রেশন সার্ভিস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা্র অ্যাপ্লিকেশন সরবরাহ করার মাধ্যমে সামরিক ও গোয়েন্দা খাতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গণহত্যার প্রথম পর্যায় শুরু হওয়ার সময় কোম্পানির সিইও অ্যালেক্স কার্প “ফক্স বিজনেস” কে জানান: “আমরা ইসরায়েলে বিখ্যাত।”

২০২৪-এর ১২ জানুয়ারি গণহত্যায় সহায়তা করার জন্য “প্যালান্টির” ইসরায়েলি মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির সাথে হাত মিলিয়েছিল। তখন“প্যালান্টির” এর তৎকালীন নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট জশ হারিশ বলেছিলেন: “উভয় পক্ষ যুদ্ধ-সংক্রান্ত সব মিশনে প্যালান্টিরেরউন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সম্মত হয়েছে।” ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি “যুদ্ধ-সংক্রান্ত মিশন” বাক্যাংশটিকে আন্তর্জাতিক আদালতসুস্পষ্টভাবে গণহত্যার অংশ হিসেবে নিশ্চিত করেছে। ঐ কোম্পানির সাথে সংযুক্ত সিস্টেম “টাইটান” কে সুনির্দিষ্ট টার্গেটে আঘাত করতে ব্যবহার করা হয়। গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বিবেচনা করলে আপনি বুঝতে পারবেন যে যে এটি দিয়ে প্রচুর বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল ২০২৫ -এ “হিল অ্যান্ড ভ্যালি” ফোরামের সময় কোম্পানির সিইও অ্যালেক্সকার্পকে ফিলিস্তিনিদের হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে “প্যালান্টির বেশিরভাগ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে এবংএটি সঠিক।” নিশ্চয়ই এটি সঠিক নয়, কারণ গাজায় নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক ছিলেন (এক্ষেত্রে ২০০৮ সাল থেকেফিলিস্তিনি মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের তথ্য উল্লেখ করতে হয়। যদি এই মৃতদের সবাই হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের সদস্যহত, তবে এই দুটি গ্রুপ হত অসাধারণ শক্তিশালী। কিন্তু তা একদমই সত্যি নয়।)। ২০২৪ সালে তেল আবিব বৈঠকে এবং ২০২৫ সালে“হিল অ্যান্ড ভ্যালি” ফোরামে কার্পের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আলবানিজের রিপোর্টের শেষে বলা হয়েছে যে “এই বক্তব্যগুলো ইসরায়েলেরঅবৈধ শক্তির ব্যবহার এবং তাদের আগ্রাসন রোধ করা বা সেগুলোয় সাহায্য না করার অসফলতা নিয়ে নির্বাহী পর্যায়ের অজ্ঞতা এবং অনিচ্ছার প্রমাণস্বরূপ।” 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিবাসীদের বের করে দেয়ার সাথে “প্যালান্টির” এর সম্পর্ক নিয়ে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ারপর সারা দেশে ঐ কোম্পানির অফিসের সামনে প্রতিবাদ শুরু হয়। এই সময় আমেরিকান সরকারের সাথে মিলে অভিবাসীদের বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের সাথে সাথে ফিলিস্তিনের গণহত্যায় তাদের ভূমিকার কথাও প্রকাশ্যে বের হয়ে আসে।

দখলদারিত্ব থেকে লাভবান হওয়া

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ও ফিলিস্তিনি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত কয়েক দশকের তদন্তে জানা যায় কীভাবে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব বড় বড় কোম্পানির জন্য লাভজনক হয়েছিল। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর মতে ইসরায়েল প্রতিবছর পশ্চিম তীর থেকে ৪১ বিলিয়ন ডলার শোষণ করে যা তার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭ শতাংশ। তবে এটি পূর্নাঙ্গচিত্র নয়, কারণ এতে শোষিত বন্দী ফিলিস্তিন জাতির কাছ থেকে ইসরায়েল যে পরোক্ষ সুবিধা নেয় তা অন্তর্ভুক্ত নেই।

২০২০ সালে জাতিসংঘ পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনের সুবিধাভোগী কোম্পানিগুলোর একটি ডাটাবেস প্রকাশ করেছে। এইকোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয়, তবে এই তালিকায় কিছু সুপরিচিত আন্তর্জাতিক কোম্পানিও রয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের“এয়ারবিএনবি,” “এক্সপেডিয়া,” “ট্রিপঅ্যাডভাইজার,” “জেনারেল মিলস,” এবং “মটোরোলা”, সেইসাথে নেদারল্যান্ডসের“Booking.com”। এছাড়াও, “হু প্রফিটস” ওয়েবসাইট দখল এবং গণহত্যা থেকে অর্থনৈতিক শোষণের সাথে জড়িত কোম্পানিরএকটি বিশদ ডাটাবেস পরিচালনা করে এবং এটি ২০২৪ সালে “ Greenwashing Dispossession: The Israeli Renewable Energy Industry and the Exploitation of Occupied Natural Resources “ শীর্ষক একটি রিপোর্ট সহ আরো কিছু নির্দিষ্ট বিশ্লেষণাত্মকরিপোর্ট ইস্যু করে। “উপরন্তু,” Don't Buy into Occupation Coalition (DBIO)” “ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি রিপোর্ট ইস্যু করে, যা অবৈধ বসতি প্রকল্পের অর্থায়নে ইউরোপীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ করে।

১০ জুন ২০২৫-এ আয়ারল্যান্ড-প্যালেস্টাইন অ্যালায়েন্স “সাদাকা” এবং ফিলিস্তিনি কোম্পানি “আল-হক” এর সহযোগিতায় গ্লোবাললিগ্যাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (GLAN) অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে ব্যবসা চালানোর কারণে আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবংমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “এয়ারবিএনবি”-এর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করে। ২০১৮ সালে এয়ারবিএনবি ঘোষণা দিয়েছিল যে “এটি নিজের কাজের প্রভাব বিবেচনা করবে এবং দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করবে।” তবে শীঘ্রই এটি নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং গ্লোবাললিগ্যাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক অনুসারে আজো এটি পশ্চিম তীরে ৩০০ টিরও বেশি বাড়ি ভাড়া দেয়। এই সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যেযা ঘটছে তা কেবল দখলদারিত্বকে সমর্থন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এতে “ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধ থেকে প্রাপ্ত অর্থ পাচার”-ও অন্তর্ভুক্তরয়েছে। 

আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের মতো কঠোর অর্থ পাচার বিরোধী আইন আছে এমন দেশগুলোতে এই অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর।গ্লোবাল লিগ্যাল অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সিনিয়র আইনজীবী জেরি লিস্টন ব্যাখ্যা করেন: “এটি এমন প্রথম মামলা যেখানে যুক্তরাজ্যএবং অন্যান্য জায়গায় স্থাপিত অবৈধ বসতিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালানোর বিচার করতে গিয়ে অর্থ পাচার বিরোধী আইন ব্যবহারকরা হয়েছে। এছাড়া এই মামলায় দখল থেকে লাভবান হওয়া কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভরাও গুরুতর অপরাধের জন্যফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি হন।”

এই কোম্পানিগুলো যে শুধু দখল থেকে প্রাপ্ত আর্থিক মুনাফা থেকে লাভবান হয় তা নয়। এরা ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে এবং পরিবেশের গুরুতর ক্ষতি করে। এর একটি উদাহরণ হলো “গেশুরি” অ্যাগ্রোকেমিকেল কোম্পানি- যা তুলকার্ম শহরের আশেপাশেরপরিবেশকে দূষিত করে এবং সেখানকার ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ে ক্যান্সার, হাঁপানি, চোখের রোগ এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগের হার বৃদ্ধি করে। এবং একই ঘটনা পশ্চিম তীরেও দেখা যায়, যেখানে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো দূষণ, নিষ্কাশন এবং মুনাফা লাভের জন্য ফিলিস্তিনেরসম্পদ ব্যবহার করে।

ফিলিস্তিনিদের দমন করা এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উন্নত গুপ্তচরবৃত্তি কৌশল বিকাশের উন্মুক্ত পরীক্ষাগারেপরিণত হয়েছে। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো “পেগাসাস”, এমন একটি স্পাইওয়্যার প্রোগ্রাম যা সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট৮২০০ এবং ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একত্রে ব্যক্তিগত মূলধন ব্যবহার করে তৈরি করেছে। এই প্রোগ্রামটি কেবল ফিলিস্তিনেসীমিত নেই, বিশ্বের বিভিন্ন অংশের স্বৈরশাসক সরকার এর মাধ্যমে ৫০, ০০০ এরও বেশি মানুষকে টার্গেট করে ভিন্নমতাবলম্বীদেরট্র্যাক ও দমন করেছে।

২০২০ সালে বয়কট, বিভাজন এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন (BDS) অনুসারে ইসরায়েলি সাইবার কোম্পানিগুলো এই খাতে বৈশ্বিকবিনিয়োগের প্রায় ৩১ শতাংশ অর্জন করেছে। এই কোম্পানিগুলোর অধিগ্রহণের চুক্তিগুলো প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে, আর তাদের রপ্তানি প্রায় ৬.৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এইভাবে ডেটা সংগ্রহ এবং প্রসেসিং-এ নিজের দক্ষতা ব্যবহার করে ইসরায়েল গুপ্তচরবৃত্তি এবং নজরদারির জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। এর প্রদত্ত সেবার মধ্যে রয়েছে স্পাইওয়্যারপ্রোগ্রাম, ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি এবং নিপীড়ন, নির্বাচনী কারসাজি জাতীয় কাজে ব্যবহৃত ইউজার-ট্র্যাকিং টুল।

জেনোসাইড জেন্ট্রি (গণহত্যা থেকে লাভবান ধনীদের প্রকল্প)

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এখানেও সন্দেহের তীর নির্বাহী নেতাদের দিকেই যায়। প্রজেক্ট “জেনোসাইড জেন্ট্রি” পেন্টাগনের সব মূলঠিকাদার- বোয়িং, এলবিট সিস্টেমস আমেরিকা, জেনারেল ডায়নামিক্স, লকহিড মার্টিন, নর্থ্রপ গ্রুমম্যান এবং আরটিএক্স (প্রাক্তনরেথিয়ন)-এর মতো অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সিনিয়র নির্বাহীদের উপর আলোকপাত করে। ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম“লিটলসিস” নির্মিত প্রকল্পটি এই কোম্পানিগুলোর সিনিয়র নেতাদের নাম প্রকাশ করে, অন্যান্য কোম্পানির সাথে তাদের সম্পর্কঅনুসরণ করে এবং তারপরে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের সংযোগ খুঁজে বের করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে দুর্বল লিঙ্কহিসেবে ধরা হয় কারণ তারা নিজেদের তহবিলের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও গণহত্যায় জড়িত কোম্পানির সাথে নিজের সম্পর্ক জনসমক্ষে প্রকাশ করে না।

“জেনোসাইড জেনট্রি” তিন-ধাপের কৌশল ব্যবহার করে:

1.  আপনার শহর, বিশ্ববিদ্যালয়, বা কর্মক্ষেত্র এবং গণহত্যার মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে একটি ডাটাবেসের মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানেরকাউন্সিলে কোনো অস্ত্র কোম্পানির পরিচালকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিনা তা জানা। 2.  অস্ত্র কোম্পানীর সাথে সম্পর্কযুক্ত সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা। 3.  স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এবং যুদ্ধের নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে সরাসরি সংযোগ খুঁজে বের করতে পরিচালনা পর্ষদ এবং দাতাদের ফাইল ব্যবহারকরা।

জেনোসাইড জেন্ট্রি-র একটি দারুণ উদাহরণ এখানে দেয়া হলো: ক্যাথি ওয়ার্ডেন “নর্থ্রপ গ্রুমম্যান” এর সিইও। তিনি “নারী-বান্ধবকর্মক্ষেত্র” তৈরি করতে সহায়তা করে এমন একটি বিশ্বব্যাপী অলাভজনক কোম্পানি “ক্যাটালিস্ট” এর বোর্ড সদস্য। ইউএন উইমেন-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গাজায় কমপক্ষে ২৮, ০০০ নারী ও মেয়েশিশু অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছে, যার বেশিরভাগ অস্ত্র “নর্থ্রপগ্রুমম্যান “-এ উৎপাদিত হয়েছিল। ইউএন উইমেন আমাদের সংস্থাকে এই বলে সতর্ক করে যে ওই কোম্পানিতে উৎপাদিত অস্ত্রের কারণে গাজায় এক মিলিয়নেরও বেশি নারী ও মেয়েশিশু দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। এটিই “ ক্যাটালিস্ট” এবং নারীদের সুরক্ষায় এরতথাকথিত স্লোগানের আসল সত্য।

এই কৌশলটি থেকে বেশ কিছু লাভ হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম দিকে কিছু আন্দোলনকারী অস্টিনে অনুষ্ঠিত “সাউথ বাইসাউথওয়েস্ট” (SXSW) উৎসবে অংশগ্রহণকারী সঙ্গীতশিল্পীদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। মার্চ মাসে, শিল্পী এলা উইলিয়ামস (স্কুইরেল ফ্লাওয়ার নামে পরিচিত) অস্ত্র কোম্পানির স্পনসরশিপের কারণে উৎসব থেকে তার নাম প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি ইনস্টাগ্রামেলেখেন: “এসএক্সএসডব্লিউ ডিফেন্স কন্ট্রাক্টরদের সহায়তা নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে রেথিয়নের অধীন কিছু প্রতিষ্ঠান, এছাড়াও আছেইউএস আর্মি, যে কিনা এই উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। রেথিয়নের মতো গণহত্যার সুবিধাভোগীরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের দেয়া ট্যাক্সের অর্থ দিয়ে আইডিএফকে অস্ত্র সরবরাহ করে। একটি সঙ্গীত উৎসবে যুদ্ধের সুবিধাভোগীদের থাকা উচিত নয়।তাই আমি এতে অংশ নেবো না এবং এর প্রতিবাদে আমার নাম এই উৎসব থেকে প্রত্যাহার করলাম।” তারপরে আরও ৭৯ জন শিল্পীঐ উৎসব বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জুন মাসে এসএক্সএসডব্লিউ উৎসব আমেরিকান সেনাবাহিনী এবংরেথিয়ন (RTX) এর সাথে তার সম্পর্ক শেষ করার ঘোষণা দেয়

এতকিছুর পরও গণহত্যা অব্যাহত থাকায় এটা সুস্পষ্ট যে ফিলিস্তিনের চলমান দখলদারিত্ব থেকে মুনাফা উশুল করার পেছনে বড় বড়বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। ফিলিস্তিনের বাস্তবতা বড়ই হতাশাজনক এবং নির্মম। তবে এখন এর সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণরয়েছে। যেমন আলবানিজের রিপোর্ট, যা ইহুদি দখলদারিত্বের অধীনে ফিলিস্তিনের দুর্দশা এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে ইহুদিদের নির্মমআচরণের সত্য প্রকাশ করে। এছাড়াও কীভাবে এইসব কোম্পানিগুলো এবং তাদের প্রযুক্তি ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন করতে ব্যবহারকরা হয় এবং কীভাবে তারা নিজেদের এইসব দুষ্কর্মকে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক বলে চালাতে চাইছে তাও ধরা পড়েছে। এইসব নিয়ে প্রচুরপ্রমাণ পাওয়া গেছে যা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। এইসব প্রমাণের পর আন্তর্জাতিক কোম্পানি, আদালত বা জনমতের অবশ্যইকিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত। নীরব থাকা আর সম্ভব নয়, কারণ সবাই মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরাও মুক্ত নই।

উবাই আল-আবুদি ফিলিস্তিনের রামাল্লায় বিসান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক এবং উন্নয়ন সমস্যা এবংফিলিস্তিনি অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত একজন গবেষণা কর্মী।

বিজয় প্রসাদ একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক। তিনি ট্রাইকন্টিনেন্টাল ইন্সটিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চের ডিরেক্টর এবংলেফটওয়ার্ড বুকসের এডিটর-ইন-চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

Available in
ArabicEnglishSpanishGermanFrenchItalian (Standard)TurkishBengaliRussian
Authors
Vijay Prashad and Ubai Al-aboudi
Translator
ProZ Pro Bono
Date
17.11.2025
Source
Al SifrOriginal article🔗
PalestineWar & Peace
Privacy PolicyManage CookiesContribution SettingsJobs
Site and identity: Common Knowledge & Robbie Blundell